Author: স্বাগতা বিশ্বাস
DOI Link: https://doi.org/10.70798/Bijmrd/020100009
সার সংক্ষেপ: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ছাড়াও ছোটগল্পকার হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পিতৃদত্ত প্রকৃত নাম হলেও তাঁর ছদ্মনাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হিসেবেই বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যে তিনি সুবিদিত। কঠিন বাস্তবের নিখুঁত বর্ণনা আমাদের রোমকূপে শিহরন তোলে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে সেই সময়ের ঘটনার কাঁচ ঝকঝকে শব্দায়ন একজন জাত-কথাসাহিত্যিককেই আমাদের সামনে নিয়ে আসে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই সময়ের সামাজিক চালচিত্র অক্ষরসংলাপে সময়কে গল্পের পিঞ্জরে বন্দি করেছেন। অসুস্থ সমাজ, অসুস্থ মানুষের ছবি এঁকেছেন বিভিন্ন ছোটগল্পে। সেইরকম কিছু ছোটগল্প হল —’দুঃশাসন’, ‘ডিম’, ‘পুস্করা’, ‘ভাঙা চশমা’, ‘বীতংশ’, ‘কালো জল’, ‘ওস্তাদ’, ‘মেহারা খাঁ’, ‘হাড়’, ‘বস্ত্র’, ‘নীলা’, ‘নক্রুচরিত’, ‘ডিনার’, ‘তীর্থযাত্রা’, ‘নেতার জন্ম’, ‘অধিকার’ ইত্যাদি। মানুষ শুধু খাবার খেয়ে বাঁচে না, খাবার খেয়ে মরে। অনেকদিনের খাদ্যাভাবে খাবার না পেয়ে হঠাৎ খাবার পেয়ে গেলে শরীরে ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডোম পাগলি, হঠাৎ অতিরিক্ত সুস্বাদু খাবার পেয়ে এবং খেয়ে তার শরীরে দেখা দেয় সমস্যা জলের জন্য মাটিতে গড়াগড়ি করছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় জল তেষ্টায় জিভ বার করে মা কালীর মতো হাঁপাচ্ছে এক ফোটা জলের জন্য। ‘পুস্করা’ গল্পের জীবন সত্য আমাদের বেদনার্দ্র করে । ‘দুঃশাসন’ শব্দটি বর্তমানে মিথ, মিথ-কল্প চরিত্র। মহাভারতের চরিত্র, তার স্থিতি অবস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও মানব সমাজ আপামর ভারতীয় সভ্যতা দুঃশাসনকে কোনদিন এক মুহূর্তের জন্য ভালো বলবে না। আমাদের ভারতীয় সভ্যতা নারীদের, মেয়েদের, কন্যারত্নকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দিয়ে এসেছে সেই চর্যার যুগ থেকে। মাতৃতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের দেশ সমগ্র মানববিশ্বে পরিচিহ্নিত। গল্পকার সমাজের সেই দুঃশাসনদের চিহ্নিত করেছেন তাঁর ‘দুঃশাসন’ গল্পে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা একটি ছোটগল্প হল—’বস্ত্র’। গল্পের নায়ক নগ্ন ছাদেম ফকির অন্ধকার রাত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সে শ্মশানে গিয়েছে মৃতদেহের পরিত্যক্ত বস্ত্রখণ্ড খুঁজতে। পেয়েও গেছে। কিন্তু সমস্যা হল—এই নতুন বস্ত্র দিয়ে সে তাদের পরিবারের কার কার লজ্জা নিবারণ করতে পারবে ? কারোর শরীরেই তো বস্ত্র নেই। তার নিজের স্ত্রীর, না তার পুত্রবধুর। শেষপর্যন্ত ছাদেম ফকির সেই নতুন বস্ত্রখানি গলায় দিয়েই আত্মহত্যা করে। লাশকাটা ঘরে চালান করার সময় ছাদেম ফকিরের গলা থেকে কাপড় খুলে দু-টুকরো করে কেটে শরীরে জড়িয়ে ছাদেম ফকিরের স্ত্রী আর তার পুত্রবধু মহাসুখে কাঁদতে বসে। কী অদ্ভুত মোচড়ে গল্পকার মানুষের ভেতরের অভিরাগ ব্যঞ্জনা করেন! সত্যিকার জাত-লেখক এরকমই। ‘নক্রু’ শব্দের অর্থ হল ‘কুমীর’। অর্থাৎ কুমীর যেমন তার শিকার ধরার জন্য মরার ভান করে পড়ে থাকে, তেমনি ‘নক্রুচরিত’ গল্পের নিশিকান্ত। সে নক্রুচরিত্রের অধিকারী। গ্রামের মদনযোগী, বিশাখা, ইব্রাহিম দারোগা, প্রভৃতি চরিত্রগুলি কোন না কোনভাবে তার শিকারে পরিণত হয়েছে। আমাদের সমাজে ‘নক্রুচরিত’ টাইপের চরিত্রের কিন্তু অভাব নেই। ‘হাড়’ গল্পটির পটভূমি ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ। কৃষিনির্ভর মানুষ গ্রাম ছেড়ে দুর্ভিক্ষের দিনে শহরের দিকে ছুটে গিয়েছিল। তারা ভেবেছিল শহরে অন্তত খাদ্যাভাবে তারা প্রাণে মারা যাবে না। যে আশা আর প্রত্যাশা নিয়ে শহরের জৌলুস ছুঁতে গিয়েছিল তা আখেরে পতঙ্গের আগুনপ্রীতি ছাড়া আর কিছু নয়। গল্পের পটভূমি কলকাতা শহর। সমাজের দুই বিপরীত শ্রেণির মানুষের শ্রেণিগত পরিচয় এই গল্পে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সমাজসচেতন, দায়বদ্ধ একজন ছোটগল্পকার। মহামারি, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশভাগের মতো দৈশিক, রাজনৈতিক, পালাবদল তিনি সরাসরি চোখে দেখেছেন। দেখেছেন খেটে খাওয়া মানুষের অন্তরে তখনও বেঁচে থাকা মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা সহমর্মিতা। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা সরলতার সুযোগ নিয়ে চরম ক্ষতি করতে পিছপা হয় না। চোরাকারবার, খাবারে ভেজাল মেশানো, গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে তাদের পণ্যে পরিণত করার মতো অতি নৃশংস ঘটনাও তাঁর গল্পের অবয়ব গঠন করেছে। সহস্র খারাপের মধ্যে পৃথিবীতে এখনো ভাল মানুষ রয়েছেন—তার গল্পে সেই আভাস আমরা পাই।
সূচক শব্দ: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশ-ভাগ, খাদ্যাভাব, বস্ত্রসংকট, ‘দুঃশাসন’, ‘ডিম’, ‘পুস্করা’, ‘ভাঙা মা’, ‘বীতংশ’, ‘কালো জল’, ‘ওস্তাদ’, ‘মেহারা খাঁ’, ‘হাড়’, ‘বস্ত্র’, ‘নীলা’, ‘নক্রুচরিত’, ‘ডিনার’, ‘তীর্থযাত্রা’, ‘নেতার জন্ম’, ‘অধিকার’ ‘শিঙবোঙা’, ‘করমদেবতা’ ।
Page No-1 – 7