দেশভাগের যন্ত্রণা আর দুর্ভিক্ষের মর্মভেদী রূপকার: সৈয়দ ওয়ালীওল্লাহ

Author: স্বাগতা বিশ্বাস 

DOI Link: https://doi.org/10.70798/Bijmrd/02110019

Abstract: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ছোটগল্পকার। ‘লালসালু’ (১৮৪৮), ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) নামের তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস আমাদের বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আধুনিক উপন্যাসের অস্তিত্ববাদী, চেতনাপ্রবাহ রীতি পদ্ধতির সুচারু প্রয়োগ তার উপন্যাসে আলো ফেলেছে। নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পাঠক এবং দর্শকের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। ‘বহিপীর’ (১৯৬০), ‘তরঙ্গভঙ্গ’, (১৯৬৪), সুড়ঙ্গ’ (১৯৬৪), ‘উজানে মৃত্যু’ সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, (১৯৬২) প্রভৃতি নবযুগোপযোগী নাটক তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়েছে। শুধু তাই নয়—বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর লেখা ছোটগল্প গ্রন্থগুলি হল— ‘নয়নচারা’ (১৯৪৪), ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৫)।

 ‘নয়নচারা’ (১৯৪৪) গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত নাম-গল্পটিতে ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রতিচ্ছবি গল্পকার তুলে ধরেছেন। এই গল্পে আমু, ভুতো, ভূতনি, প্রভৃতি চরিত্র এই গল্পের কুশিলব। ময়ুরাক্ষী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে একটি গ্রামের নাম ‘নয়নচারা’। এই গল্পটি আসলে একটি জনপদের স্থাননাম-কেন্দ্রিক গল্প। ছোটগল্পের নামকরণের হাজারও জটিল সূত্র বা ব্যঞ্জনা থাকলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এই গল্পে একটি সাদা-মাঠা গ্রামের নামকেই তাঁর গল্পের শীর্ষনাম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ‘নয়নচারা’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত আর একটি দুর্ভিক্ষ পীড়িত সময়ের চিত্রলেখা উঠে এসেছে— ‘মৃত্যু-যাত্রা’ নামক ছোটগল্পে। গল্পের নামকরণ থেকেই আমাদের অনুভবে জেগে ওঠে— এ মৃত্যুর পদানুসরণ প্রক্রিয়া। মৃত্যুর দিকে যাত্রা। ১৩৫০-এর সর্বাত্মক দুর্ভিক্ষে বাংলার গ্রামকে গ্রাম শ্মশানে পরিণত করেছিল। অসুখে বিসুখে, অনাহারে, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর মরণান্তিক তাগিদ আমাদের বাংলাদেশ সেদিন মারাত্মকভাবে ধাক্কা পেয়েছিল।

 রক্ত’ নামের গল্পটি ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় লেখা হলেও আসলে একটি জটিল মনস্তত্ত্ব এই গল্পদেহে রাখা হয়েছে। গল্পের কাহিনি খুব অল্প, গল্পের নায়ক—আবদুল। কারণ সাত বছর আগে সে গ্রাম সমাজ প্রতিবেশি বন্ধু বান্ধবের মমত্ব ত্যাগ করে জাহাজে চড়ে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়েছিল—উপার্জনের আশায়। সেইদিন থেকে তার সমস্ত মমতার বন্ধন ছিন্ন হয়ে হৃদয়ের ভেতরে যে রক্ত ঝরছিল—আজও সেই রক্তের বহমান ধারা অব্যাহত। গভীর রাত্রে কাশতে কাশতে আবদুলের মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছে— সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। একসময় আক্কাশের বউ, আক্কাশ তাঁকে শুশ্রূষা করেছে, মাথায় হাওয়া দিয়েছে তাদের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে তাকে সুস্থ করার জাগতিক সমস্ত রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ‘রক্ত’ গল্পের গঠনে বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি থাকলেও সেই পটভূমি আক্রান্ত সাধারণ মানুষের জীবনকে হতাশার সমুদ্র সফেনে ভরিয়ে দিয়েছিল— তারই নিদারুণ অক্ষরচিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বোপরি গল্পটি মানবিক চেতনার রন্ধ্রপথে স্নেহ-প্রেম-প্রীতিরই সুপ্ত অস্তিত্বকেই যেন পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন। ছোটগল্পকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের আরও একটি ছোটগল্প ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’। এটি ‘দুই তীর ও  অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৫) গ্রন্থের অন্তর্গত একটি প্রতিনিধিস্থানীয় ছোটগল্প। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রেক্ষাপটকে পটভূমিতে করে এই গল্প রচিত। দেশভাগের ফলে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ— একটি হিন্দু আর অন্যটি মুসলমান সম্প্রদায় তাদের জাতিগত পরিচয়ের পরকাষ্ঠা কত বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল তারই বেদনাক্ষুব্ধ প্রকাশ ঘটেছে এই গল্পে। এই ধর্ম বিভিন্ন মানুষের আসল পরিচয় মানুষ, তবু তারা সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক পালাবদলের কুশীলব তারা, সময়ের হাতে ক্রীড়নক। দেশপ্রধানেরা দুইধর্মের মানুষের জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র– পাকিস্তান এবং ভারত চায়। তখন প্রাণের ভয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো তাদের নিজ নিজ ধর্মের মানুষের কাছে যেতে নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করেন। নিজের বাস্তু ছেড়ে অজানা অচেনা দেশে আশ্রয়হীন হয়ে যে তুমুল অশান্তি অনিশ্চয়তা ভোগ করেছিল— সেই মর্মদ্ভুত ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পকার ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ গল্পটি রচনা করেছেন।

সূচক শব্দ: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘বহিপীর’ (১৯৬০), ‘তরঙ্গভঙ্গ’, সুড়ঙ্গ’, ‘উজানে মৃত্যু’, ‘নয়নচারা’, ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’। ‘নয়নচারা’, ‘জাহাজি’, ‘পরাজয়’, ‘মৃত্যুযাত্রা’, ‘খুনি’, ‘রক্ত’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’, ‘সেই পৃথিবী’, ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ।

Page No: 159-167